স্বদেশ ডেস্ক:
দেশ তোলপাড় করা রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের বালিশকাণ্ডের দুর্নীতি মামলা তদন্তের নামে চলছে ‘তেলেসমাতি কাণ্ড’। তিন দফা বদল করা হয়েছে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। দুর্নীতিতে জড়িত অতিরিক্ত প্রধান, নির্বাহী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ কয়েকজনকে বাদ দিয়ে ‘ফরমায়েশি’ চার্জশিটের ছকে পা দেওয়ায় সংশ্লিষ্টদের এ পরিবর্তন বলে অভিযোগ। এ অবস্থায় তিন হাত ঘুরে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন অধস্তন এক কর্মকর্তা। তিনি ডকেট বুঝে নেওয়ার আগে প্রায় চার মাস কার্যত বন্ধ ছিল এই মামলার তদন্ত। আগের তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনজনই ছিলেন উপপরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার। গুঞ্জন আছে, ‘ফরমায়েশি’ চার্জশিট করিয়ে নিতেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নানা নাটকীয়তায় তদন্তের দীর্ঘসূত্রতায় জামিনে মুক্ত হয়ে গেছেন সব আসামি। যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
এদিকে ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর বালিশকাণ্ড দুর্নীতির ঘটনায় দুদকের তিন মামলার তদন্ত ৬ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বেঁধে দেওয়া সময় পার হয়েছে ২০২১ সালের এপ্রিলে। কিন্তু এখনো তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল না করায় হাইকোর্টের আদেশও উপেক্ষিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানাতে চাইলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার জানা মতে মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক নাসির উদ্দিন তদন্ত শেষ করে চার্জশিট চূড়ান্ত করে কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিলেন। ওই অবস্থায় তিনি বদলি হন। এরপর যারা এসেছেন তারা হয়তো আর কাজটি এগিয়ে নেননি। হাইকোর্টের বেঁধে দেওয়া সময়ে তদন্ত শেষ না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্ট আমাদের কাছে আর কিছু জানতে চায়নি।’ তিন উপপরিচালকের পর অধস্তন একজন কর্মকর্তা দিয়ে মামলা তদন্তের নজির দুদকে আছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি জানি না। তবে আইনগত কোনো বাধা নেই।’ তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বলার মতো আপডেট কোনো তথ্য নেই।’
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় পৃথক চারটি মামলা দায়ের করে দুদক। সংস্থাটির উপপরিচালক নাসির উদ্দিন ও উপসহকারী পরিচালক শাহজাহান মিরাজ বাদী হয়ে পাবনায় দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে এ মামলা করেন। মামলার আসামি হিসাবে ১১ প্রকৌশলীকে গ্রেফতারও করেছিল দুদক। তারা সবাই এখন জামিনে মুক্ত। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রূপপুরে বালিশকাণ্ডের দুর্নীতি সংঘটিত হয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। দুর্নীতির ঘটনায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ২৮ প্রকৌশলীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়। আর দুদকের অনুসন্ধান শেষে মামলায় আসামি করা হয়েছে ১১ প্রকৌশলীকে।
অভিযোগ আছে, ঘটনার শুরু থেকেই মন্ত্রণালয় ও দুদকের অসৎ কিছু কর্মকর্তা তদন্ত এবং অনুসন্ধান ভিন্ন খাতে নিয়ে বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীকে রক্ষায় কাজ করেছেন। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ২৮ জন প্রকৌশলীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে মাত্র ১৬ জনকে। দুদকের অনুসন্ধান শেষে করা মামলায় এদের মধ্যে ৫ জনকে আসামি করা হয়নি। মামলায় আসামি না হলেও এখনো তারা চাকরি ফিরে পাননি। জড়িতদের সবার বিরুদ্ধে একই ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় মন্ত্রণালয় ও দুদকের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
জানা গেছে, আসামি তালিকায় নাম না থাকলেও তদন্তে দুই অতিরিক্ত প্রধান, তিন নির্বাহী, দুই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য-উপাত্ত পান তদন্ত কর্মকর্তা। যাদের নাম মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনেও রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের আলোকে মামলার চার্জশিটে নতুন করে এদের কয়েকজনকে অভিযুক্ত করার কাজ চূড়ান্ত করা হয়। এ অবস্থায় অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক নাসির উদ্দিনকে বদলি করা হয় রাজশাহীতে। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানও বলেছেন, ‘আমি জানতাম নাসির উদ্দিন চার্জশিট চূড়ান্ত করে, কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিলেন। এরপর তিনি বদলি হন।’
জানা গেছে, নাসির উদ্দিনের পর মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান দুদকের উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিক। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তার কাছেও মামলার তদন্তভার বেশিদিন থাকেনি। এরপর দায়িত্ব পান সংস্থাটির তরুণ উপপরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। দায়িত্ব পেয়ে কাজ শুরুর ৬-৭ মাস পর তাকে প্রধান কার্যালয় থেকে বদলি করা হয়েছে পটুয়াখালীতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছয় মাস আগে মামুনুর রশীদ চৌধুরী দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে বদলি হয়ে পটুয়াখালীতে যোগ দেন। সঙ্গত কারণেই তাকে মামলার ডকেট হস্তান্তর করতে হয়। গত ৩০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে মামলার ডকেট বুঝে নেন নতুন তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান। তিনি এখন নতুন করে মামলার নথি পর্যালোচনার কাজ করছেন। একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তা বদলে মামলার কাজে তৈরি হয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। আর এই মামলা ঘিরে গড়ে ওঠা চক্রের সদস্যরা দুর্নীতিপরায়ণ প্রকৌশলীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। অথচ দুই বছর আগে মামলার তদন্ত শেষ করতে ছয় মাসের সময় বেঁধে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত, তদন্তে যে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে তাতে সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শফিকুর রহমান (বর্তমানে অবসরে), অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নজিবুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জিল্লুর রহমান, দেবাশীষ চন্দ্র সাহাসহ জড়িত অন্তত ২ ডজন প্রকৌশলী দুর্নীতিতে জড়িত। অভিযোগপত্র থেকে এদের রেহাই পাওয়ার সুযোগ কম। এদের কাউকে রেখে কাউকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দিলে মামলা দুর্বল হবে। আদালতও সেটা গ্রহণ না করে উলটো তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা করতে পারেন। এক্ষেত্রে ‘ফরমায়েশি’ চার্জশিট দিতে চাপ দেওয়া প্রভাবশালীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও ফেঁসে যাবেন তদন্ত কর্মকর্তা। এ কারণেও চার্জশিট দাখিলে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়েছে।
দুর্নীতিবাজরা চিহ্নিত : যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুদক তদন্ত শেষ করার আগেই মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দুর্নীতিবাজরা চিহ্নিত হয়েছে। সেসব তদন্ত প্রতিবেদনও সংগ্রহ করে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা। ২০১৮ সালে রূপপুর প্রকল্পের ৬ লটের দরপত্র নিয়ে সুনির্দিষ্ট ৫টি অনিয়মের অভিযোগের ভিত্তিতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। কমিটি অভিযোগের পুরো বিষয়টি পাশ কাটিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। তাতে বলা হয়, আলোচ্য অভিযোগ তদন্তের নির্দেশনা দেওয়ার আগেই দরপত্রগুলোর নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। তাই এ পর্যায়ে অভিযোগটি আমলে নেওয়া বিধিসম্মত হবে না। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আইনি জটিলতা সৃষ্টি ও ভবন হস্তান্তরে বিলম্ব হবে।’
কমিটির রিপোর্টের আলোকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরই ফাঁস হয় বালিশকাণ্ডের মতো ভয়াবহ দুর্নীতির ঘটনা। এরপর মন্ত্রণালয়ের গঠিত ৫ সদস্যের আরেক তদন্ত কমিটি দুর্নীতির কারণ ও জড়িতদের শনাক্ত করে ২০১৯ সালের ৭ জুলাই একটি প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনের ২৮ পৃষ্ঠার দশ দশমিক আট নম্বর ক্রমিকে বলা হয়েছে, তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৯টি কাজে ঘুরেফিরে অংশ নিয়েছে। তিনটি দরপত্রে মাত্র ১টি দরদাতা এবং বাকি ৬টি দরপত্রে মাত্র দুটি করে দরদাতা অংশ নিয়েছে। নয়টি কাজের মধ্যে মজিদ সন্স কনসর্টিয়াম লি. তিনটি কাজ, সাজিন কন্সট্রাকশন লি. চারটি কাজ ও জিকেবি (জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠান) দুটি কাজের কার্যাদেশ পায়। সার্বিক বিশ্লেষণে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা রয়েছে মর্মে কমিটি মনে করে। প্রাক্কলন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সুপারিশ, যাচাই-বাছাই ও অনুমোদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদেরও চিহ্নিত করে তদন্ত কমিটি। এরা হলেন, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (বর্তমানে অবসরে) শফিকুর রহমান, নজিবুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী তানজিলা শারমিন. নূরুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একেএম জিল্লুর রহমান, দেবাশীষ চন্দ্র সাহাসহ উপসহকারী ও সহকারী প্রকৌশলী পদমর্যাদার ২৮ জন। এদের মধ্যে যে ১৬ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাদের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী ও একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সবাই উপসহকারী ও সহকারী প্রকৌশলী পদমর্যাদার কর্মকর্তা। আবার একই অপরাধে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একেএম জিল্লুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেবাশীষ চন্দ্র সাহা আছেন বহাল তবিয়তে। তিনিই মূলত অভিযুক্ত প্রকৌশলীদের এক ছাতার নিচে এনে ‘ফরমায়েশি’ চার্জশিট তৈরিতে মোটা টাকার তদবিরে মাঠে নেমেছেন বলে অভিযোগ আছে। এদের রক্ষায় বড় ভূমিকা পালন করে গেছেন সংস্থাটির সাবেক এক মহাপরিচালক (তিনি প্রেষণে কর্মরত ছিলেন)। দুদকের মামলায় যে ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে তাদের মাত্র একজন নির্বাহী প্রকৌশলী পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছাড়া বাকি সবাই উপসহকারী ও সহকারী প্রকৌশলী পদমর্যাদার। অর্থাৎ মন্ত্রণালয় ও দুদক কেউই রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দুদকের অনুসন্ধান শেষে দুই ঠিকাদার ও ১১ প্রকৌশলীসহ ১৩ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। এক ব্যক্তিকে একাধিক মামলার আসামি করা হয়েছে। এ হিসাবে চারটি মামলায় মোট আসামি দেখানো হয়েছে ৩৩ জন। তবে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মামলায় আসামি যে কজনই হোক, চার্জশিটে আসামি বাড়বে এবং দোষী কেউ পার পাবে না।
জানতে চাইলে প্রকৌশলী একেএম জিল্লুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলার তদন্তে প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ নেই। প্রভাব খাটাতেই যদি পারতাম, তাহলে চার বছর ধরে সাসপেন্ড অবস্থায় থাকতাম না। তদন্ত কর্মকর্তাদের বদলির প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। তাছাড়া প্রকল্প থেকে যেসব ঠিকাদার অতিরিক্ত বিল নিয়েছিলেন তারা সমুদয় অর্থ (৩৬ কোটি ৪০ লাখ ৮ হাজার ৬৭৬ টাকা) সরকারি কোষাগারে ফেরত দিয়েছেন। প্রকল্পের টাকা সমন্বয় করে তা সরকারকে অবহিত করাও হয়েছে। এরপরও মামলার বাদী নাসির উদ্দিন সাহেব (মামলার অনুসন্ধান ও প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা) এজাহারে প্রকল্পের ওই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। টাকা ফেরতের বিষয়টি গোপন করে গেছেন। এই মামলার আসলে মেরিট নেই। তাই তারা চার্জশিট দিতে পারছে না।’
মন্ত্রণালয়ের তদন্ত ও দুদকের অনুসন্ধানে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও কীভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেবাশীষ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘এটা যেহেতু এখনো তদন্তাধীন বিষয়, তাই এ ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’